রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৫ পূর্বাহ্ন
খায়রুল আলম রফিক : যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি প্রকল্পে বেকার যুবক, যুবতীর প্রশিক্ষণ প্রদান না করে কিভাবে প্রশিক্ষকের সম্মানীভাতা, মাঠকর্মীদের বেতন ও ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে নামে-বেনামে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম সনদ তৈরী করে ২৯২ কোটি ১১ লাখ ৫১২ টাকা আত্মসাৎ ও অপচয় করেন ময়মনসিংহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক উপ- পরিচালক ফারজানা পারভীন, সাবেক সহকারী পরিচালক নুরুজ্জামান চৌধুরী, ১০ উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা, ব্র্যাক ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা এবং কয়েকটি ব্যাংক কর্মকর্তা ও হিসাবরক্ষক,অফিস সহকারীগন।
এ বিশেষ সংবাদ প্রকাশ হলে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশনায় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে তার একটি নমুনা তুলে ধরা হয়েছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ, জামাতপন্থী পরিচালক মফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি সরেজমিনে ময়মনসিংহে তদন্ত আসেন। এই উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ময়মনসিংহ ইন্টারন্যাশনাল মোস্তাফিজ আবাসিক হোটেলে রাখা হয় এবং তাদের ভিআইপি খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ময়মনসিংহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক ডিডি ফারজানা পারভীনসহ অন্যান্য সকল অভিযুক্ত কর্মকর্তারা মোস্তাফিজ হোটেলে বসে একটি গোপন প্রতিবেদন তৈরী করেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিকট থেকে একটি লিখিত পত্র সংগ্রহ করেন। যা সিসি ফুটেজ যাচাই করলেই সত্যতা পাওয়া যাবে। যেখানে তারা সকলেই প্রত্যয়ন দেন যে তারা কোন দুর্নীতি করেন নাই, যথারীতি তদন্ত কর্মকর্তারা অনৈতিক সুবিধা গ্রহন করে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আলী রেজাকে প্রধান করে তার নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি ময়মনসিংহে সরেজিমনে তদন্তে আসেন । ময়মনসিংহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক ডিডি ফারজানা পারভীন এর নেতৃত্বে কতিপয় অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে ময়মনসিংহ আন্তর্জাতিক মানের হোটেল সারিন্দা-তে রাত ৮.০০টায় আলোচনায় বসেন এবং পরিচালক মফিজুল ইসলাম এর তদন্ত রিপোর্ট তাদের নিকট দাখিল করেন। তারা সকলেই একই রিপোর্ট দেওয়ার জন্য তার সঙ্গে রফা দফা করেন বলে একাধিক গোপন সুত্র জানিয়েছেন।
সে মোতাবেক ময়মনসিংহে চার দিন অবস্থান করেন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি । প্রথম দিন আবাসিক যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দুপুর ১.০০টা পর্যন্ত ক্লাশ গ্রহন করেন, তারপর বেলা ২.০০ টায় যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা ফুলবাড়ীয়ার নিমন্ত্রনে (২২ প্রকারের খাবার) দুপুরে খেয়ে সেখানে গমন করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে আধা ঘন্টা কথা বলে দুপুরে খাবার খেয়ে চলে আসেন ময়মনসিংহে। পরেরদিন হালুয়াঘাট উপজেলায় সকাল ১১ ঘটিকায় পৌছে যুব উন্নয়ন কর্মকতার অফিসে নাস্তা গ্রহন করেন। হালুয়াঘাট পার্ক, ভারত সীমান্ত পার হয়ে অন্যান্য আকর্ষনীয় স্থান দর্শন করে পূণরায় উপজেলায় যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার(অভিযুক্ত) দেওয়া (২০ প্রকারের) খাবার গ্রহন করেন এবং পরে ময়মনসিংহে চলে আসেন। আবার একই নিয়মে ময়মনসিংহের বিখ্যাত রেষ্টুরেন্ট Saffron -এ রাতের খাবার খেয়েছেন।
গৌরীপুর উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার দেয়া নাস্তা ও আপ্যায়ন গ্রহন। একইভাবে পরদিন নান্দাইল ভ্রমন। সেখানেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ তারপর উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার দেয়া দুপুরের রাজকীয় ভোজ গ্রহন, তারপর নান্দাইল উপজেলায় দর্শনীয় স্থান সমূহ দেখে রাত্রে থাকার হোটেলে তদন্তকারী কর্মকর্তার দলবলকে আবার রাত্রে হোটেলে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। একইভাবে শেষদিন ত্রিশাল উপজেলায় গমন করার পর কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য স্থাপনা ঘুরে দেখেন। তারপর দুপুরের খাওয়া যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার দেয়া ভোজে অংশ গ্রহন করেন এবং পরিচালক মফিজুল ইসলাম-এর রিপোর্টের সঙ্গে একমত থাকায় তদন্ত কার্যক্রম আর নতুন করে পরিচালনা করার প্রয়োজন হয়নি।
তবে পরিচালক মফিজুল ইসলাম এর তদন্ত রিপোর্টের মত রিপোর্ট চাইলে খরচের পরিমান হবে জনপ্রতি ৫(পাঁচ)লক্ষ টাকা? ময়মনসিংহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি প্রকল্পে ২৯২ কোটি টাকা দুর্নীতি, অপচয়ের তদন্ত টিমের জুনিয়র কর্মকর্তা ফরহাত নূর, উপপরিচালক (যিনি ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির সিলেটের ১৪ কোটি টাকা আত্মসাতের সাথে সরাসরি জড়িত থাকায় মন্ত্রণালয় হতে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারী ও বিভাগীয় মামলা চালু করার সুপারিশ করা হয়েছে) এর মাধ্যমে সব Contact সম্পন্ন হয়েছে। থানায় জিডিও করা হয়েছে। যেকোন সময় গ্রেফতার হতে পারেন। এছাড়া ময়মনসিংহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক ডিডি ফারজানা পারভীনের নিজ গ্রামে (শশুরবাড়ীর) ভালুকায় তার স্বামীর বন্ধু যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপ- সচিব ডাঃ জহিরুল ইসলাম দামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছেন।
প্রতিদিনের কাগজের হাতে আসা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের একটি নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সাবেক ডিডি ফারজানা পারভীন দীর্ঘ ১৮ বছর ময়মনসিংহে চাকুরী করছেন এবং তার বিরুদ্ধে দুদকসহ একাধিক অভিযোগ তদন্তধীন রয়েছে। ফারজানা পারভীন ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির প্রকল্প চলাকালে জামালপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ -এ চাকরী করেছেন। তখন অবৈধ পথে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছে বলে প্রতিদিনের কাগজের অনুসন্ধানে উঠে আসে । যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর উদ্দেশ্য ভাল ছিল। সঠিকভাবে তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তির আওতায় এনে সরকারী অর্থ আদায় করে কোষাগারে জমা দিতে । কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তাগণ নিজেদের পকেটভারী করে অভিযুক্তদের অর্থের বিনিময়ে বাচিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন।
তদন্ত কমিটির অনিয়মের কারনে ময়মনসিংহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের “ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি প্রকল্পের বরাদ্দের ২৯২ কোটি ১১ লাখ ৫১২ টাকা” দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপচয়ের ঘটনায় সাবেক ডিডি ফারজানা পারভীনসহ ৭ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন সিনিয়র সাংবাদিক মোঃ খায়রুল আলম রফিক। আদালতের নির্দেশে ময়মনসিংহের দুদক মামলাটি অনুসন্ধানে নামে । তাদের পত্রের মাধ্যমে ডেকেছেন। সকলেই লিখিত জবাব দিয়েছেন বলে জানাগেছে।
অভিযোগে জানা যায়, ময়মনসিংহ ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি প্রকল্পের চলমান প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে জেলা কমিটিতে সভাপতি, জেলা প্রশাসক, সদস্য সচিব উপপরিচালক, উপজেলা কমিটিতে সভাপতি, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সদস্য সচিব উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা। ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির প্রশিক্ষণ কোর্সে জেলা প্রশাসক সেসন পরিচালনা করেছেন ১০টি, তার বিপরীতে উপপরিচালক ফারজানা পারভীন সেসন পরিচালনা করেছেন ২০০০টি(প্রতিটি ১ ঘন্টায়) এবং সহকারী পরিচালকগণ গ্রহন করেছেন ৫০০০টি (প্রতিটি ১ ঘন্টায়) এবং সম্মানী ভাতা গ্রহন করেছেন (প্রতি সেসন x ১০০০=১০০০), উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা গ্রহন করেছেন ১০০০-১২৮০টি, এভাবে জেলা ও উপজেলায় প্রাক্তন উপপরিচালক ফারজানা পারভীন এর নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ না করেই প্রশিক্ষণের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ময়মনসিংহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক মৎস্য প্রশিক্ষক বদরুজ্জামান ফকির যিনি ব্রেন স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে আছে তাকেও দেখানো হয়েছে ৮১৮টি ক্লাশ। এর বিনিময়ে টাকাও উত্তোলন করেছেন।
ময়মনসিংহ শহরের মাসকান্দা আবাসিক এলাকায় বদরুজ্জামান ফকিরের বাসায় গিয়ে দেখা যায় তিনি বিছানায় শুয়ে আছে। কোন কথাও বলতে পারেন না। মেয়ে প্রতিদিনের কাগজকে জানান,আমার বাবা ব্রেন স্ট্রোক করেছেন। তিনি কিভাবে ক্লাস নিলেন? এসব নাটক। এভাবে অনেক কর্মকর্তার নাম ভাঙ্গিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ত্রিশাল সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার তার তদন্তে উল্লেখ করেছেন ২৩২ জন প্রশিক্ষণার্থী ভূয়া, তাই ৫২ লক্ষ টাকা সরকারী কোষাগারে জমা রাখা হউক। এরকম আরো সুনির্দিষ্ট তথ্য উল্লেখ করার পরও তদন্তকারী কর্মকর্তাগণ কোন কিছু তদন্ত না করে নিজের পকেট ভারী করে চলে যান। তাদের বিষয়ে কে ব্যবস্থা নিবেন?
অথচ সারা দেশ ব্যাপী ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচিতে কি পরিমান দূর্নীতি হয়েছে তার সঠিক চিত্র জানার জন্য ইতিমধ্যে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাই কর্তৃপক্ষের নিকট অনেকেই দাবী জানিয়েছেন কমিটির কার্যক্রম সঠিক করছে কিনা তাও মনিটরিং-এ রাখা দরকার।
ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান কার্যালয়ের কতিপয় কর্তকর্তা/কর্মচারীর যোগসাজসে মাঠ পর্যায়ে কতিপয় Selected নির্বাচিত কর্মকর্তা দ্বারা কর্মসূচি সম্পন্ন বা কর্মসূচির অন্তর্ভূক্ত নয় এরকম এলাকায় মারাত্মক দূর্নীতির চিত্র আসার সাথে সাথে আবার নির্বাচিত কতিপয় কর্মকর্তা দ্বারা তদন্ত সম্পন্ন করে দূর্নীতিকে আড়াল করা হয়েছে। যেমন সিলেট, গাইবান্ধা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, শেরপুর জেলার IBAS++ বরাদ্দ, প্রশিক্ষণ/প্রশিক্ষক সম্মানী, সংযুক্তি ইত্যাদি অনিয়ম নিয়ে দুদক তদন্ত করছেন।
যেমন ৩৬ জেলায় ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি চালু ছিল, তার মধ্যে জামালপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ তিন জেলায় অভিযুক্ত দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ফারজানা পারভীন দায়িত্বে ছিলেন। এভাবেই একই কর্মকর্তাকে দিয়ে দূর্নীতি করানো হয়েছে। ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির জেলা/উপজেলা পর্যায়ে প্রদানকারী এবং নিয়ন্ত্রনকারী হিসেবে অবৈধভাবে অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রদান করে এবং তাদের নিকট থেকে অবৈধ সুবিধা গ্রহন করে অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা কোটি কোটি টাকার মালিক। যারা তাকে দীর্ঘ ১৩ বৎসর যাবৎ এ পদে বসিয়ে অবৈধ সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেছেন তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা জরুরী বলে দাবি জানিয়েছেন অনেকেই ।
কেননা, তারাই এসকল অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সমূহ তদন্ত করে তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং তাদেরকে তাদের সুবিধা জনক স্থানে পদায়নের ব্যবস্থা করেন। ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির আওতায় ৩৬ জেলার উপ- পরিচালককে তাদের পূর্বের কর্মস্থণের বাইরে রেখে দুদক এর মাধ্যমে তদন্ত করলে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকা উদ্ধার করা সম্ভব। যু্ব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অত্যন্ত সৎ, কিন্তু তার আশপাশের কয়েকজন কর্মকর্তাগণ অত্যন্ত দুর্নীতিবাজ হওয়ায় তারাই এসকল অবৈধ কাজগুলি সম্পন্ন করে চলেছেন। তাছাড়াও সচিব নতুন কিন্তু তার পুরাতন কর্মকর্তাগণ দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের রক্ষার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে চলছে। এবিষয়ে কিশোরগঞ্জের উপপরিচালক (ডিডি) ফারজানা পারভীনের বক্তব্য জানতে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। তাকে বার্তা পাঠিয়েও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।